অভিমত অর্থনীতি এই মাত্র জাতীয় প্রিয় লেখক বাংলাদেশ ব্রেকিং মু: মাহবুবুর রহমান

করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণ

মু: মাহবুবুর রহমান

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়েছে। ২০২০ সালে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে যা ছিল ২৪.৫ শতাংশ। সে হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এর খানা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির এক ওয়েবিনারে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দেশের ৬৪টি জেলার উপর চালানো ‘মানুষের দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানেম।

সানেমের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর করোনার সময়ে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

সানেমের জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে জীবন নির্বাহ করেছেন, কেউ ঋণ নিয়েছেন, আবার কেউ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। সানেমের জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৭.৫২ শতাংশ পরিবার বলেছে, করোনার প্রভাবের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর কোনো পথই পায়নি তারা।

জরিপে আরও বলা হয়, ২০২০ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যক্তিক পর্যায়ে তা বরং কমে গেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, অনানুষ্ঠানিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী আয় এসেছে। এতে বিনিময় হার কমে গেছে। জরিপে ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পরিবার বলেছে, দেশের বাইরে থেকে আসা প্রবাসী আয় কমেছে। একই ক্ষেত্রে আগের মতো আছে বলেছে ১৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবার। ফলে প্রবাসী আয়ের প্রভাব সমাজে অতটা অনুভূত হয়নি।

জরিপে আরও বলা হয়, দরিদ্রতা বাড়ার ফলে শিক্ষা ও চিকিৎসায়ও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষা ব্যয় কমেছে। অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য এই হার কমেছে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ। পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও অনেক কম। কারণ তাদের অনলাইন সুবিধা গ্রহণের সক্ষমতা নেই। অন্যদিকে, গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় বেড়েছে। মধ্যম ও অদরিদ্রদের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি-যথাক্রমে ৯৭ ও ১০৪ শতাংশ।

শনিবার (২৩ জানুয়ারি) ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে জরিপের এসব ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এমএম আকাশ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সহ অন্যান্যরা।

অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, সানেম নিজস্ব অর্থায়নে জরিপটি পরিচালনা করেছে। এতে দারিদ্র্য, অসমতা ও কর্মসংস্থান এই তিনটি ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের প্রভাব নিরূপণ করা হয়েছে। তিনি জানান, “রংপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ বিভাগে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। অর্থাৎ গরিব হয়েছে আরো গরিব, ধনী হয়েছে আরো ধনী।”

দারিদ্র্যের হারের সঙ্গে আয় বৈষম্যও বেড়েছে জানিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, “মহামারী শুরুর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের দরিদ্রতম ২০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট আয়ের ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ পেত। আর দেশের মোট আয়ের ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ আয় করত দেশের ধনী ৫ শতাংশ মানুষ। কিন্তু করোনার প্রভাবে সেই অবস্থা পাল্টেছে। এখন দেশের মোট আয়ের ১৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ ধনী ৫ শতাংশের দখলে। দেশের মোট আয়ের ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ দরিদ্রতম ২০ শতাংশের দখলে।”

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় সাধারণত ভোগ দিয়ে। কিন্তু দারিদ্র্য যে বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা ও চিকিৎসায়ও এর প্রভাব দেখা যায়, সানেমের জরিপ এই প্রথম এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিচ্ছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “এই দারিদ্র্যের হার যাতে দীর্ঘমেয়াদী না হয়, সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখা দরকার।” স্কুলগুলো আবার খুলে দেয়া সহ চিকিৎসা খাতে সাবসিডি বাড়ানোর ওপর মত দেন তিনি।

সানেম ২০২০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সারা দেশে ৮ বিভাগের ৬৪টি জেলার ৫ হাজার ৫৭৭টি পরিবারের ওপর গবেষণাটি চালায়। নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা। এই গবেষণার সময়কাল ২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর। অর্থাৎ করোনাভাইরাস মহামারীর আগের অবস্থার সাথে পরের অবস্থা তুলনা করা হয়েছে জরিপে। এই গবেষণায় ফোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

Related posts

করোনায় মারা গেলেন উপসচিব আবুল খায়ের

Irani Biswash

ওমিক্রন: যেসব শর্তে চলবে গণপরিবহন

razzak

বাংলাদেশে আরো সুইস বিনিয়োগের আহ্বান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর

razzak

Leave a Comment

Translate »