#কাউন্সেলিং_টেবিলের_গল্প_
“The effects of unresolved trauma can be devastating. It can affect our habits and outlook on life, leading to addictions and poor decision-making. It can take a toll on our family life and interpersonal relationships. It can trigger real physical pain, symptoms, and disease. And it can lead to a range of self-destructive behaviors.”
Peter A. Levine
“আপনার মুখ আ্যসিমিট্রিকাল।” মেয়েটা ঢুকেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
আমি শান্ত স্বরে বললাম, ” তার মানে কি জানো?”
মেয়েটি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, ” কি?”
আমি বললাম, ” তারমানে আমি সুন্দরী না। সুন্দরী বলে মানুষের মস্তিষ্কর চিহ্নিত করার একটা ক্রাইটেরিয়া হলো সিমিট্রি। প্রকৃতি সমতা পছন্দ করে।”
মেয়েটার বয়স ২৩। দেশের প্রথম শ্রেণীর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বৃত্তি নিয়ে। কর্মজীবী বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। একটা ছোট ভাই আছে।
” আমার ভাইটা না থাকলে কবেই আত্মহত্যা করতাম! আমাকে আত্মহত্যা করার হাত থেকে বাঁচাতে পারেন?”
মেয়েটি একবারও আমার সাথে আই কন্টাক্ট করেনি। আমার চেম্বারে অনেক গাছ। একটা স্নেক প্ল্যান্টের পাতায় আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল, ” আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না।”
আমি ধীরে ধীরে বললাম, ” তুমি বুদ্ধিমতি। এত অল্প পরিচয়ে বিশ্বাস করাটা ঠিকও হবে না।”
মেয়েটি, ” আমি পৃথিবীর কোন মানুষকে বিশ্বাস করি না। আপনার পিয়ানোটা দারুন। আমি কি বাজাতে পারবো? আমি এখন পর্যন্ত কোনো ডাক্তারের চেম্বারে পিয়ানো দেখিনি!”
আমি বললাম, ” তুমি পারো?”
মেয়েটি, ” আমি বারবার চেয়েছি পিয়ানো বাজাতে, কিন্তু মা জোর করে গিটার বাজাতে পাঠিয়েছে। দিনের পর দিন আমি চাইনি তার পরেও।” ধীরে ধীরে মেয়েটার গলার স্বর স্তিমিত হয়ে আসলো। ঠোটের উপর ঠোঁট চেপে বসেছে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছ।
আমি বললাম, ” আমি কি তোমাকে টাচ করতে পারি?”
মেয়েটি বলল, ” না। আমি কোন টাচ নিতে পারি না।”
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ” টাচ ভয় হয় নাকি ঘৃণা হয়?”
শোনা যায় কি শোনা যায় না, এমন ধীর গলায় মেয়েটা ফিসফিসিয়ে বললো, “দুটোই।”
তারপর চুপচাপ।
সময় বয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটা আনমনে পিয়ানোতে টুংটাং করছে। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বললাম, ” তোমার সেক্সুয়াল এবিউসার কি তোমার টিচার ছিলেন?”
মেয়েটি থর থর করে কেঁপে উঠলো।
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
মেয়েটিকে সেরা বানানোর লক্ষ্যে, ভালো স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি ছবি আঁকা, গিটার শেখার স্টিমরোলার চলত। যাতে সব কিছুতেই টপমোস্ট মুকুটটি মেয়েটার মাথায় থাকে। কিন্তু এর ফলে বাচ্চাটা কতটুকু ক্লান্ত হচ্ছে, সেটা কখনোই আমলে নেয়া হয় নাই। কতটুকু হলে সেরা বলবে? কতটুকু দৌড়ালে বলবে থামো সেই প্যারামিটার কখনোই ঠিক হয়নি। কোথাও কোনো ডেডলাইন ছিল না। শুধু অবিশ্রান্ত দৌড় ছিল। এতো চাপের খেসারত দিতে গিয়ে বাচ্চাটা যে দিনের পর দিন একাধিক গৃহ শিক্ষকের কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ভয়ের চোটে মুখ ফুটে সেটা মা’কে সে বলতে পারেনি। কারণ মা তো তখন মেয়েকে সেরা করার জীবন যুদ্ধে বিভোর। শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত একাধিকবার বাচ্চাটা মলেস্টেশনের শিকার হয়েছে, নিজ বাড়িতে, এমনও হয়েছে বাবা মা বাসায় ছিলেন তখনও। মা’কে কিছু বলতে গেলেই, মা মনে করতেন, বাচ্চাটা পড়া ফাঁকি দেয়ার জন্য পড়তে চাচ্ছে না।
এই মা’টি নিজের বাচ্চাকে বিশ্বাস করতেন না। ফলশ্রুতিতে, মস্তিষ্কের ‘মিরর নিউরন’ বাচ্চাটিকে শিখিয়েছে, মা’কে বিশ্বাস করা যায় না। মিরর নিউরনগুলো আন্তঃসম্পর্কের টেমপ্লেট হিসেবে আমাদের মস্তিষ্কে কাজ করে। বাচ্চার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন হবে, সেটা নির্ধারিত হবে আমি বাচ্চাকে যা দেবো বাচ্চা আমাকে সেটাই ফেরত দেবে। মোদ্দাকথা আমার আচরণ আমার বাচ্চার ব্যবহারে প্রতিফলিত হবে। আমরা কখনোই বলি না, প্রবলেম চাইল্ড, আমরা বলি বাবা-মার আচরণ বাচ্চারা ফেরত দেয়। মস্তিষ্কের মিরর নিউরনের জন্যই এই ঘটনা ঘটে।
সাইকোথেরাপিতে একটা কথা আছে, “যা আমরা নিজেরা মা’কে বলতে পারি না তা আমরা নিজেকেও বলতে পারিনা।”
ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে বাচ্চাটা নিজেকে বিশ্বাস করাও বন্ধ করে দিয়েছে। আর আত্মবিশ্বাস না থাকলে যা হয়, একদম গুড়ো গুড়ো হয়ে আমার কাউন্সেলিং টেবিল পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এখন তার প্রচন্ড মুড সুইং হয়, ঘুম হয় না, মনোযোগ নেই, পড়তে পারছে না, নিয়মিত গোসল করছে না, ঘর গোছাচ্ছে না, বিষন্নতায় ভুগছে, প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত, ঘনঘন প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে, কখনো কখনো তীব্র রাগে ফেটে পড়ছে, কখনো তাকে সীমাহীন অস্থিরতা গ্রাস করছে। সেই সাথে ফ্ল্যাশব্যাকের মতন সেক্সুয়াল এবিউসের স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে, দুঃস্বপ্ন দেখা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের কোন কথা, আলোর রং বদল, সিগারেটের গন্ধ সেই বিপর্যস্ত স্মৃতিগুলোকে ট্রিগার করছে। খুব সহজ ভাষায় বললে মেয়েটি Post-traumatic stress disorder (PTSD)তে ভুগছে।
যৌন নির্যাতন, মনোদৈহিক নির্যাতন, অন্যের মৃত্যু দেখা, ভালোবাসার মানুষের চলে যাওয়া/ মৃত্যু, বুলিং, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, বড় আকারের আঘাত বা অসুস্থতা, বড় ধরনের কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ( গাড়ি এক্সিডেন্ট / বাড়িতে আগুন লাগা ইত্যাদি যেকোনো কিছুই PTSD তৈরির সুপ্ত কারণ হতে পারে।
যেই কারনে আমরা আরেকজনকে, “এটা কোন ব্যাপার না ! সবাই পারে তুমি পারো না কেন? এত অল্প সহ্যশক্তি কেন? তুমি অল্পতে অস্থির হও কেন? ” এই কথাগুলো কখনোই বলবো না। আপনি কি জানেন যে তাঁর অতীতের কোন স্মৃতিটি তাকে কষ্ট দিচ্ছে? তাকে অস্থির করছে? আপনার জন্য হয়তো কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু ওই মানুষটির জন্য এটা ভীষণ ভয়ঙ্কর ব্যাপার হতেই পারে।
এই বাচ্চাটা যেমন বাবা সিগারেট খেলে হুলুস্থুল করে। কারণ সিগারেটের গন্ধ তাকে তার সেই আবিউজার গৃহশিক্ষকের ঘিনঘিনে স্পর্শের কথা মনে করিয়ে দেয়। একে কি বলা যায়, “সিগারেট নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন করো?”
PTSD একটা মানুষকে চুষে ছিবড়ে করে করে নেয় এতে মানুষের কর্মদক্ষতা কমে যায়, আন্ত সম্পর্কে মরচে ধরে , মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের এবং মনোসামাজিক স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।
মনে রাখতে হবে, আমাদের দৈহিক আঘাতের ক্ষতগুলি শুকিয়ে যায়, কিন্তু মনের আঘাত হিল হতেও পারে আবার আজন্ম এর থেকে অদৃশ্য রক্তপাতও হতে পারে। PTSD কিন্তু মানুষের দুর্বলতা নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোন মানুষ এর শিকার হতে পারে।
এর মধ্যেও মেয়েটিকে ঘরের কাজ কেন করছে না, ওমুকের বাচ্চা এই করেছে, গেস্টের সাথে ভালো ব্যবহার কেন করছে না, ক্লাসে কত ক্রেডিট নিল, কেমন পড়াশোনা করল, ঠিকমতো রেজাল্ট ভালো না হলে বৃত্তি চলে যাবে এইসব শুনতে হচ্ছে। যে মানুষটা দিনরাত সুইসাইড করার প্ল্যান করছে, তাকে যখন একাডেমিক রেজাল্ট ভালো করার জন্য ফোর্স করা হয়, ঘরের কাজে হাত দিচ্ছে না কেন বলে দোষ দেয়া হয় তখন তার মনোভূমি থেকে বাবা মা যে কতটা বিচ্ছিন্ন থাকেন সেটা বোঝাই যায়। অথচ এই বাবা-মা’র থেকে বাচ্চাটিকে আর কেউ বেশি ভালোবাসে না। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন বাবা-মা আর এই বাচ্চাটির মনোজগৎ আজ আলাদা হয়ে গেছে। মাঝখানে কোন সংযোগ সেতু নেই।
এই বাচ্চাটার বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে বিষয়টা ফোনে আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলে তিনি এক কথায় বলেন, “আমি ওকে চিনতে পেরেছি। ও বলেছিল আমার ফেস আ্যসিমিট্রিকাল। ওকে চিন্তা করতে মানা করেন। একটু সময় নিক। আমি সব টিচারদেরকে বলে দিচ্ছি অ্যাসাইনমেন্টের জন্য ওকে যেন কোনো চাপ দেয়া না হয়। আমার এরকম কয়েকটা বাচ্চা আছে। এই কথাটা আমাদের মধ্যে কনফিডেনশিয়াল থাকবে। “
কতজন বিভাগীয় চেয়ারম্যান তাঁর শত শত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এভাবে একজনকে সহজে আইডেন্টিফাই করতে পারেন? আমি সেই বিভাগীয় চেয়ারম্যানকে স্যালুট দিই।
“শিশুরা শিক্ষা লাভ করবে আনন্দের সাথে।” রবীন্দ্রনাথের এই আপ্তবাক্য কয়জন অভিভাবক আদৌ বুঝতে পারেন আমার সন্দেহ আছে। তাই বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা-মার অসমাপ্ত অসফল স্বপ্ন পূরণের রক্তমাংসের হাতিয়ার হল সন্তান। বাচ্চাটার কি হল না হল তার থেকেও বেশি ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে কত নাম্বার পেল! কি প্রাইস পেল! বাচ্চাগুলো হয়ে যাচ্ছে বাবা-মার সোশ্যাল ট্রফি! আমি কত ভালো বাবা-মা তার প্রমাণ হচ্ছে আমার বাচ্চার রেজাল্ট কত ভালো। আমরা সব সময় বাচ্চার doing (কাজ) প্রমোট করি, being ( অস্তিত্ব) কে নয়। আমরা কয়জন বাচ্চা কে বলি, যে তুমি সুস্থ ভাবে বেঁচে আছে সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি? আমাদের কয়জনের বাচ্চা ফেল করলেও বিনা ভয়ে বাবা মা কে বলতে পারে?
পরবর্তীতে এই বাচ্চাগুলো তীব্র নিঃসঙ্গতা, কখনো প্রচন্ড ভয়, কখনো প্রচন্ড রাগ নিয়ে বেড়ে ওঠে। না পারে কাউকে বিশ্বাস করতে না পারে নিজের ইমোশনের ব্যালেন্স রাখতে। নিজের অজান্তেই বারবার এবিউসিভ রিলেশনে জড়িয়ে যায়। প্যানিক অ্যাটাক হয়, আত্মহত্যায় মুক্তি খুঁজে।
এসব ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি ভালো কাজ করে। এটি একটি ধারাবাহিক পদ্ধতি। প্রচুর সময় লাগে, কিন্তু ধীরে ধীরে মনের ক্ষত সেরে উঠে। প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা যায় তবে সেটা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক। “আমাকে দিয়েছিল তুমিও খাও” এই থিওরী থেকে সরে আসতে হবে।
যারা সন্তানদের কথা জাজমেন্টাল না হয়ে বিশ্বাস করেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাকটিশনার।
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ