ইরানী বিশ্বাস
করোনার শুরুতে ২০২০ সালের মে মাসে আক্রান্ত হন ইতি ঠাকুর। পেশায় প্রাথমিক প্রধান শিক্ষিকা। সন্তানদের কাছে ঢাকা এসে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই করোনাক্রান্ত হন। করোনাক্রান্ত হয়ে মারা যান স্বামী । তবে কিছুদিন পর তিনি করোনামুক্ত হন। কিন্তু ভুলতে পারছেন না সেসব দিনের স্মৃতি।
এখন কী কী সমস্যা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব ভুলে যাই। কোথায় কী রেখেছি মনে থাকে না। এছাড়া চাকরির কারণে পরিবার ছেড়ে একাই ঢাকার বাইরে থাকতে হয়। এই একাকীত্ব আরও বেশি ক্ষতি করছে। ধীরে ধীরে কনফিডেন্স কমে আসছে। এখন একটুতেই শরীর খারাপ হয়। মাঝে মাঝেই জ¦র হয়। টিকার ২ ডোজ নিয়েছি। তবুও করোনা যেন পিছু ছাড়ছে না। মনে মধ্যে সারাক্ষণ করোনাতঙ্ক।’
বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতেই করোনাক্রান্ত হয়ে ২৭ দিন বাসায় একঘরে বন্দি ছিলেন ওমর ফারুখ। এরপর তিনি নিয়মিত হোম অফিস করছেন। তিনি মনে করেন এখনো তাঁর শরীরের ব্যথা, নিঃশ্বাসে সমস্যা রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তিনি কিছুতেই করোনাকে ভুলতে পারছেন না। স্বাভাবিক হওয়ার পর যাকে পাচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকেই বলতে শুরু করছেন, করোনা আক্রান্তকালে তার কী কী সমস্যা হতো। সকলকে করোনা নিয়ে উপদেশ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন। কিছু নিয়ম মানার পরে মানসিক সমস্যাগুলো দূর হলেও শারীরিক সমস্যা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন।
সায়েমা খাতুন। তিনি ভীষণ শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আইসিইউতে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমার দু-তিনবার মনে হয়েছে, আর ফিরবো না। বাচ্চাটাকে আর দেখব না। দম বন্ধ হয়ে এলে কেমন লাগে এখন আমি সেই অনুভূতি জানি।’
করোনা মুক্ত হয়ে দেড় মাসের মাথায় তিনি সুস্থ জীবনে ফেরেন ঠিকই কিন্তু তারপর থেকে শুরু হয় আরেক অসুস্থতা। সারাক্ষণ সবকিছুতে করোনা আছে মনে হয় তার। বাসাতেও সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে বাধ্য করেন, সারাক্ষণ হাত ধোয়া, সারাক্ষণ সবকিছু ধোয়াধুয়ি করছেন।
করোনামুক্ত হয়েছেন তারপরও আপনার কী মনে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখনই সেসব দিনের কথা ভাবি তখনই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সারাক্ষণ অক্সিজেন লেভেল মাপার যন্ত্র গলায় বেঁধে রেখেছি। সেটা দিয়ে চট করে দেখে নিই আমার অক্সিজেনে সমস্যা হচ্ছে কিনা।
গবেষণা বলছে, করোনা থেকে সেরে ওঠা এক তৃতীয়াংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি স্নায়বিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ল্যানসেন্ট সাইকিয়াট্রি জার্নালে এ বিষয়ক গবেষণার ফলে উঠে এসেছে, করোনা থেকে সেরে ওঠার ছয় মাসের মধ্যে ৩৪ শতাংশ রোগীর স্নায়বিক ও মানসিক সমস্যা দেখা গেছে।
শুধু করোনার কারণেই নয়, করোনার প্রভাবেও মানুষের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ করোনায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। প্রত্যেকেই তার অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বিশেষ করে মধ্যম ও নি¤œ মধ্যম আয়ের মানুষের বেশি সমস্যা হচ্ছে। একেবারে নি¤œ আয়ের মানুষ তবু কারো না কারো কাছে সহজেই হাত পেতে সাহায্য চাইতে পারছে। তবে এই মিডল ক্লাশ মানুষ পড়েছে উভয় সঙ্কটে। তারা না পারছে সাহায্য চাইতে, না পারছে জীবনের এই বিপর্যয় মেনে নিতে।
করোনার কারণে ঘরে ঘরে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মহীনতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেকের সাজানো জীবনে হঠাৎ নেমে এসেছে অমানিশা। পরিবারের একমাত্র আয়-রোজগারের মানুষটির চাকরি হারানোর কারণে দেখা দিতে পারে ডিপ্রেশান। এছাড়া পরিবারের ছোটদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে ডিপ্রেশান। কারণ আগে তারা স্কুলে যেতো। বন্ধুদের সাথে দেখা হতো। গত এক বছরেরও বেশি সময় তারা স্কুলে প্রবেশ করে না। স্কুলের পরিবেশ, সহপাঠিদের জন্য মন খারাপ হতে পারে। এই মন খারাপ তাকে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশানের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এছাড়া অনেক পরিবারের একমাত্র রোজগারের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থমকে গেছে পারিবারিক জীবন যাত্রা। পরিবারের অসচ্ছলতাও ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে। অনেকেই আবার শহরের জীবন ছেড়ে বেঁচে থাকার জন্য স্থায়ীভাবে চলে গেছেন গ্রামে। হঠাৎ করে এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। এছাড়া চেনা-পরিচিত মানুষ, সহপাঠি, বন্ধু সবাইকে রেখে অন্য একটা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট থেকে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনের দিকে চলে যাচ্ছে।
ডিপ্রেশনের বাংলা প্রতিশব্দ অবসাদ। এই শব্দটির সাথে যে দুঃখ বা বিষাদ লেগে আছে, সর্বনাশা এ রোগটিও ঠিক একইরকম। ডাক্তারী মতে যা ডিপ্রেশন বলে পরিচিত, তার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে মনখারাপ আর ভাল না লাগা। যে বিভিন্ন আঙ্গিকে ডিপ্রেশন বা অবসাদ রোগটিকে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিশ^ সাস্থ্য সংস্থার দেওয়া নিয়মাবলী। এই নিয়মাবলী অনুযায়ী, অবসন্ন মন, শক্তিহীণতা, এবং উৎসাহহীনতা কে ডিপ্রেশনের আওতায় ফেলা হয়েছে। আরেকটু গভীরে গিয়ে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেক এর তত্ত¡ অনুযায়ী, ‘নিজের, পরিববেশের এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা’র সম্মিলিত প্রকাশই হলো ডিপ্রেশন।’ অবশ্য শুধু নেতিবাচক ধারণা থাকলেই চলবে না, রোজকার জীবনে তার প্রভাবও পড়া চাই।
মন ও মনের অসুখ মানেই ডিপ্রেশন নয়। আপাতদৃষ্টিতে যাকে ডিপ্রেশন বলে মনে হচ্ছে, হতে পারে তা আসলে কোন জটিল রোগের বাহ্যিক লক্ষণমাত্র। এই ব্যাপারটা মনে রাখা জরুরী। কারণ চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসার ফলাফল, দুটোই আলাদা হয় রোগের ক্ষেত্রবিশেষে।
ডিপ্রেশনের লক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মুড সুইং করা অর্থাৎ কখনও খুশি, কখনও দু:খিত হওয়া। জীবনের প্রতি ঘৃণা আসার কারণে জীবনকে অর্থহীন মনে হতে পারে। কোন বিষয়ে কথা বলা শুরু করলে সেই বিষয়টা বার বার বলতে থাকা।
প্রথমত দেখতে হবে মনখারাপ নাকি ডিপ্রেশান। মনখারাপ দু’একদিনে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মনখারাপ যদি দু’সপ্তাহ বা তার বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে বুঝতে হবে তা ডিপ্রেশনের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া দেখতে হবে, তিনি সব কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কি না। হয়তো কোন ব্যক্তি সিনেমা-সিরিজ দেখতে ভালবাসেন, গান ভালবাসেন, কিন্তু এখন সেটা আর ভাল লাগছে না। বা কেউ হয়তো রান্না করতে বা খেতে ভালবাসতেন, এখন আর সেটা ভাল লাগছে না। এর মধ্যে যে কোন দুটি লক্ষণ নজরে এলে বুঝতে হবে তিনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন। লক্ষ্য রাখতে হবে, তার খাওয়ার অনিচ্ছা দেখা দিচ্ছে কি না। ঘুম কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত ঘুমানোও ডিপ্রেশনের অন্যতম লক্ষণ। ‘লস অব এনার্জি’ও দেখা দিতে পারে। তবে অবশ্যই দেখতে হবে মানসিক কারণে হচ্ছে নাকি শারীরিক সমস্যার কারণে হচ্ছে। অনেক সময় থাইরয়েড বা অন্যান্য অসুখের কারলেও এনার্জি থাকে না।
এছাড়া ডিপ্রেশনের আরোকটি লক্ষণ হলো, ব্যক্তির সব সময় নিজের মনে অপরাধবোধ দেখা দেবে। নিজেকে দোষী ভাবতে থাকবেন। সব বিষয়ের ওপর মনোযোগ কমে যাবে। এক টানা কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারবেন না। হয়তো মুভমেন্ট কমে যাবে অথবা অতিরিক্ত বেড়ে যাবে। কাজের পরিকল্পনা বা নির্ধারন করতে পারেন না। আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার ওপর নির্ভরশীলদেরর মেরে ফেলার কথাও ভাবতে পারেন।
আমাদের দেশে মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে ডিপ্রেশনের অনুপাত ২:১। পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক মহিলা ডিপ্রেশনের শিকার হন। মেনস্টুরুয়াল সাইকেল শুরু হওয়ার সময়, সন্তান জন্মের পর, মেনোপজের আগে বা পরেও ডিপ্রেশনের শিকার হন মহিলারা। অনেক সময় ওয়ার্কিং মহিলারা ডিপ্রেশনের শিকার হন। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও কর্মজগৎ এ দুইয়ের স্ট্রেসও তাকে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। শারীর ও মন দুইয়ের উপরই অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে মানসিক অবসাদ হতে পারে।
ডিপ্রেশন কোন সাধারণ ঘটনা নয়। এটি মনের জটিল রোগ। আমাদের দেশে ডিপ্রেশনকে সাধারণ মানুষ অসুখ হিসেবেই গণ্য করে না। মন খারাপ আর ডিপ্রেশন দুটি আলাদা বিষয়। যথা সময়ে চিকিৎসা না করালে ধীরে ধীরে তা খারাপ এবং জটিল রোগে পরিণত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেরি না করে অবশ্যই ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হবে।