এই মাত্র পাওয়া জাতীয় শিক্ষা

আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংহতির ধারক বাহক পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এক সময়ের পাঠশালাটি আজ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকায় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্ম স্কুল। একটি পাঠশালা হিসেবে যাত্রা শুরু করে দেড় শতকের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অগ্রযাত্রার ইতিহাস বড়ই রোমাঞ্চকর। বুধবার (২০ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

এবছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০ অক্টোবরের পরিবর্তে ২১ অক্টোবর পালিত হবে। আগামী ২০ অক্টোবর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা. ও লক্ষ্মীপূজা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচি একদিন পেছানো হয়েছে।

গত বছরের মতো এবছরও স্বল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। ২১ অক্টোবর বেলা ১১টায় জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনা, বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের উদ্বোধন করবেন ভিসি অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক। দুপুর ১২টায় অনলাইনে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক মেডিকেল সেন্টারে টীকা কেন্দ্র উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।

জানা যায়, সেই সময় ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, অনাথ বন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায়, ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখের প্রচেষ্টায় ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্ম স্কুল যাত্রা শুরু করে। ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই স্কুলটি ভয়াবহ রকমের আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে স্কুলটি টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে। কিশোরীলাল চৌধুরী তার পিতার নামে স্কুলের নামকরণ করেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। এভাবেই ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জন্মলাভ করে জগন্নাথ স্কুল।

স্কুলের অবস্থা ভালো হওয়ায় ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ স্কুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে রূপান্তর করা হয়। মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে জগন্নাথ কলেজ যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কলেজ দ্রুত উন্নতি লাভ করায় মাত্র পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৮৮৯ সালে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৬জন এবং ১৯১০ সালের পূর্বেই জগন্নাথ কলেজের ছাত্র সংখ্যা ৫০০ জনে পৌঁছে। ক্রমান্বয়ে ১৯০৮ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজ রূপান্তরিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে এটিকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক ও জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।

পুরান ঢাকার নারী শিক্ষায় বাঁধা দূর করতে ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এই কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণ করা হলেও পরের বছরে আবার এটি বেসরকারি মর্যাদায় ফিরে যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একাট্টা হয়ে জগন্নাথের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বরাবরের মতোই ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম যে ১০ জন ১৪৪ ধারা ভেঙে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের বীজ মূলত জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বপন করা হয়। এছাড়াও ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষিত হলে তার সমর্থনে সফল হরতাল পালনে ভূমিকা পালন করে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কাজী আরেফ আহমেদ ও চিত্রনায়ক ফারুক।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নাম গর্ব করে বলতেই হয় তাঁরা হলেন- শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, আখতারুজ্জামন ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ, বিক্রমপুরের ইতিহাস খ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গবেষক গোলাম মুরশিদ ও মির্জা হারুন-অর রশিদ, বাংলাদশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথা শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া সাঁতারু ব্রজেনদাস, বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, লেখক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমাদাদুল হক মিলন, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র সাইদ খোকন, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ.আর.ইউসুফ, গায়ক ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, হায়দার হোসেন ও বিপ্লব, অভিনেতা এ.টি.এম.শামসুজ্জামান, জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, ফারুক ও প্রবীর মিত্র, জাদুকর জুয়েল আইচ প্রমুখ।

সর্বশেষ ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর সাড়ে ৭ একর জায়গা নিয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদে ৩৬টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ৬৭৯ জন শিক্ষক, ১৩ হাজার ১৬৫ জন শিক্ষার্থী, ৬৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাতটি শিক্ষাবর্ষে ২১৪ জন শিক্ষার্থী এমফিল ও ৮৭ জন পিএইচডি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বাংলাবাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রীহল ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের’ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ছাত্রী উঠানোর জন্য আবেদন নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই ছাত্রীরা হলে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পর্যন্ত অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা সংকুলান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা, নতুন একাডেমিক ভবন এবং গবেষণা কাজের সুবিধার্থে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় ২০০ একর জমিতে দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

মাত্র ১৬ বছরের পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক প্রাপ্তি আছে। বিসিএস, সরকারি ও কর্পোরেট চাকরি, ব্যাংক জবসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, ইন্টারনেট সুবিধা এবং গবেষণাগারেও নজর বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে সমগ্র ক্যাম্পাস ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে। ই-বুক সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখন সকল বই ও গবেষণা পত্রিকা পড়ার জন্য শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই সব অনলাইনে প্রবেশ করতে পারেন।

সার্বিক বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে আমি কাজ করছি। আমরা গবেষণা খাতে গতবারের চেয়ে বাজেট ডাবল করে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরি, আইসিটি, কম্পিউটার কেনা এসকল ক্ষেত্রে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। আমি ভিসি হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা শিল্প পরিষদ (বিসিএসআইআর) এর সঙ্গে চুক্তি করেছি যাতে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সহজে গবেষণা করতে পারে। আমরা শিগগিরই পরমাণু শক্তি কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের সঙ্গে চুক্তি করবো।

Related posts

সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল কাজাখস্তান

razzak

বাংলা একাডেমির নতুন সভাপতি সেলিনা হোসেন

razzak

এক শরণার্থীর নোবেল জয়

razzak

Leave a Comment

Translate »