নেফারতিতিকে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী ও ক্ষমতাবান রানী বলা হয়। তার নামের অর্থ হচ্ছে একজন সুন্দর নারী এসেছে। তাকে ‘লেডি অব গ্রেস’বা ‘লেডি অব অল বিউটি’ কিংবা ‘লেডি অব অল ওমেন’ বলে অভিহিত করা হতো। ধারণা করা হয়, তার জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৭০ সালে এবং তার মৃত্যু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩০ সালের দিকে।

১৯১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মানির একটি খননকারী দল যার নেতৃত্বে ছিলেন লুডউইগ বোরচার্ড তিনি এল-আমারনার ধ্বংসাবশেষ থেকে কাদামাটির তৈরি একটি রেলিক খুঁজে পান
নেফারতিতিকে ১৯১২ সালের আগে কেউ চিনতোই না। ১৯১২ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মানির একটি খননকারী দল যার নেতৃত্বে ছিলেন লুডউইগ বোরচার্ড তিনি এল-আমারনার ধ্বংসাবশেষ থেকে কাদামাটির তৈরি একটি রেলিক খুঁজে পান। তাতে ছিল ৩২০০ বছরের পুরনো একটি নারীর প্রতিমূর্তি। মূর্তিটি ২০ ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়।
গবেষণায় বেরিয়ে আসে সেই প্রতিমূর্তিটিই হলো রানী নেফারতিতির। সে ধ্বংসাবশেষটি এখন বার্লিনের অল্টাস মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। নেফারতিতিকে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রানী হিসেবে ঐতিহাসিকরা গণ্য করেন। তাকে অসংখ্য নামে এবং উপাধিতে অভিহিত করা হয়েছে। তাকে রুলার অফ দ্য নাইল এবং ডটার অফ গডস হিসেবে ডাকা হয়।

সে ধ্বংসাবশেষটি এখন বার্লিনের অল্টাস মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে
দীর্ঘ এবং হাসের মতো গলার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি গ্যালেনা উদ্ভিদ ব্যবহার করে তার রূপসজ্জা করতেন। প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে নেফারতিতিকে খুশি, আনন্দ এবং ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, রাজা আমেনহোতেপের জন্য সংরক্ষিত হেরেমে বেড়ে উঠেছিলেন এই নেফারতিতি। ঠিক এই কারণেই তার পিতা মাতার সঠিক কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
স্বামী ফারাও আখেনাতেনের পাশাপাশি তিনিও খ্রিস্টপূর্ব তেরোশোর মাঝামাঝি সময়ে শাসন করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এই ক্ষমতা এর আগে কোন রানীকে দেয়া হয়নি। ধারণা করা হয়, আখেনাতেনের মৃত্যুর পর পর পরবর্তী ফারাও তুতেনখামেনের আগ পর্যন্ত তিনি ফারাও হিসেবে শাসন করেন। মিশরের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় নারী, যিনি হাটসেপুতের ফারাও ছিলেন।

নেফারতিতির বিয়ে হয়েছিল তৃতীয় আমেনহোতেপের পুত্র আখেনাতেনের সঙ্গে
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নেফারতিতি ছিলেন প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী আর ক্ষমতাশালী নারী। নেফারতিতির বিয়ে হয়েছিল তৃতীয় আমেনহোতেপের পুত্র আখেনাতেনের সঙ্গে। তাদের বিয়ে ঠিক কবে হয়েছিল এ নিয়ে কোনো সঠিক ধারণা নেই। তারা দুজনে মিলে প্রাচীন মিশরে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তাদের শাসনামলকে স্বর্ণ যুগ বলা হয়েছে।
মিশরের ইতিহাসে অন্যতম দয়ালু এই রাজা রানীকে তৎকালীন জনগণের অনেকেই পছন্দ করতেন না। তার মূলে ছিল তাদের নতুন ধর্ম প্রবর্তন। প্রাচীনকালে মিশরের ফারাওদের বহু স্ত্রী থাকতো। কিন্তু রানী উপাধি তাদেরকেই দেয়া হতো যারা কিনা যোগ্য ফারাওয়ের জন্য ছেলে সন্তান জন্ম দিতে পারতেন।
নেফারতিতি ছয়টি কন্যান্তানের জন্ম দিলেও ইতিহাসে তার পুত্রসন্তানের কোনো সঠিক হদীস পাওয়া যায়নি। তার ছয় কন্যাসন্তান হলো আঁখেসেনামুন, নেফারনেফেরুয়াতেন তাশেরিত, মেরিতাতেন, নেফারনেফেরুর, মেকেতাতেন, সেতেপেনরে। তাদের মাঝে দুইজন পরবর্তী রানী হয়। তাদের একজন ছিলেন মেরিতাতেন।

বিভিন্ন হায়ারোগ্লিফিকে আখেনাতেন ও নেফারতিতিকে কন্যা সন্তানের সঙ্গে দেখা গিয়েছে
বিভিন্ন হায়ারোগ্লিফিকে আখেনাতেন ও নেফারতিতিকে কন্যা সন্তানের সঙ্গে দেখা গিয়েছে। সেখানেও পুত্র সন্তানের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায়নি। তাকে তুতেনখামেনের মা মনে করা হলেও গবেষণায় দেখা যায়, তিনি আসলে তুতেনখামেনের জন্মদাত্রী মাতা নন। তিনি ছিলেন তার শাশুড়ি এবং সৎমা। তবুও কেন তিনি রানীর মর্যাদা পেলেন এই নিয়ে ইতিহাসবিদদের বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে।
তবে ধারণা করা হয়, তার অসাধারণ রুপের সঙ্গে অসামান্য ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং আখেনাতেনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা এবং অগাধ সমর্থন তাকে এই আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। নেফারতিতির মোহনীয় রূপ এবং বাচনভঙ্গি দিয়ে যে কাউকে বশ করতে পারতেন। হয়তো তার উপর ভরসা করেই আখেনাতেন সবচেয়ে বড় এবং অসম্ভব বিপদসংকুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং আখেনাতেন সঠিক ছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন তার যোগ্য স্ত্রী রানী নেফারতিতির এমন সমর্থন যা হয়তো তিনি এর আগে কারো কাছ থেকে পেতে পারতেন না।

রানী নেফারতিতি
তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখন পর্যন্ত এই ক্ষমতাশালী নারীর মৃতদেহ কিংবা তার সমাধি নিয়ে রহস্যই থেকে গেছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ এখনো এই নিয়ে গবেষণা করছেন। দ্বিতীয় আমেনহোতেপের মন্দিরে তিনটি মমি পাওয়া যায় এবং যার মধ্যে দুইটি ছিল নারীর এবং একটি ছিল অল্প বয়সী কোন ছেলের, একটি ছিল আখেনাতেনের মা তুতেনখামেনের দাসি এবং আমেনহোতেপের তৃতীয় স্ত্রী রানী তিয়ার, আরেকটি ছিল তারই ছেলে যে অকালে মারা গিয়েছিল প্লেগে আক্রান্ত হয়ে। যদিও তার নাম সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় তিনি আখেনাতেনের ছোট ভাই ছিলেন। তৃতীয় মমিটি ছিল খুবই আশ্চর্যজনক।
ডাক্তার ফ্লেচার বলে একজন গবেষক ধারণা করেন সেই মমিটি ছিল রানী নেফারতিতির। কারণ ডাক্তার ফ্লেচার এমন এক সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন, যা এর আগে কেউই করেনি। আর তা হলো প্রাচীন মিশরীয় নারীদের চুল নিয়ে গবেষণা। প্রাচীন রানীরা বিভিন্ন পরচুলা এবং মুকুট পরিধান করতেন, যা তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসব এবং আয়োজনে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত করতো।

ধারণা করা হয় মমিটি ছিল রানী নেফারতিতির
এই পরচুলা এবং মুকুট নিয়ে গবেষণা করে তিনি দেখতে পান যে এক ধরনের বিশেষ মুকুট বিশেষভাবে পড়লে যেই অংশে দাগ পড়ার কথা সেটা আছে এবং এই লক্ষ্যে তিনি মমিটাকে নেফারতিতি বলে ধারণা করে তা প্রমাণের জন্য চেষ্টা চালান, যা সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ। যদিও সেই সময় ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। এই মমিটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সম্পূর্ণ মমিটা ক্ষতবিক্ষত ছিল।
কে বা কারা যেন এর মুখমণ্ডলে আঘাতের পর আঘাত করে একপাশটা ধসিয়ে দিয়েছে। তার বক্ষোজর যেন কারা কেটে নিয়ে গিয়েছিল এবং সে মমির শরীরে ছিল না কোনো ব্যান্ডেজ। হয়তো মিশরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীর জীবন শেষ হয়েছিল প্রতিহিংসাপরায়নদের হাতে। যেই সত্য আমরা কখনোই হয়তো বা জানতে পারবো না।