এই মাত্র এই মাত্র পাওয়া জীবনধারা

মহামারীর বছরে নারী নির্যাতনে ঊর্ধ্বগতি

চলমান করোনা মহামারীতেও বছরজুড়ে নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বিদায়ী বছরে নারী নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। চার বছর আগের তুলনায় নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ গুণ। সারা বছর সাধারণ নারীরা যেমন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন একইভাবে করোনা আক্রান্ত অনেক কর্মজীবী নারীও তার আপনজনের কাছে আর্থিকভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

যৌন হয়রানির হাত থেকে বাদ যাননি গ্রামের নারী থেকে শুরু করে প্রখ্যাত শিল্পী। এ বছর ধর্ষণের বিভীষিকা এতই বেড়েছে যে চলন্ত বাসেও নারীযাত্রী আর নিরাপদ নয়। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে সরকার ঘরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। উল্টো নির্যাতনের আরও নতুন ধরনের শিকার হতে হয়েছে ভুক্তভোগী নারীদের।
নির্যাতনের পরিসংখ্যান : সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহামারীর মধ্যেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটে ২১ হাজার ৭৮৯টি যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। সে হিসাবে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ২২২টি। যা আগের অর্থবছরে ছিল পাঁচ হাজার ৮৪২টি। অন্যদিকে নারী নির্যাতনের ঘটনা এক বছরে ১২ হাজার ৬৬০টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ হাজার ৫৬৭টি হয় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১০৭ জন নারীর মৃত্যু হয় স্বামীর নির্যাতনে। পারিবারিক সহিংসতার কারণে ৯২ জন নারী আত্মহত্যা করেন। ৪১ জন নারীকে তার নিজ পরিবারের লোকজন হত্যা করে। পারিবারিক সহিংসতার জন্য ২৬৬টি মামলা দায়ের করা হয়। সংস্থাটির তথ্যমতে, এ সময় ১০১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২৩৪ জন। ২৮৬ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এ জন্য মোট মামলা হয় ৮৬৪টি। ১১ মাসে মোট ১০৯ জন নারী ও তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। এদের মধ্যে ১০ জন আত্মহত্যা করেন। আর মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর দেওয়া তথ্যে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে মোট ৫৫ জন গৃহবধূর অকাল মৃত্যু হয় এবং নির্যাতনে ৯৭ জন আহত হন।

হেল্পলাইনে ভুক্তভোগীর কল : মহামারীর এই সময়ে বিশ্বে সহিংসতার শিকার হয়ে আগের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি নারী হেল্পলাইনে ফোন করেছেন বলে ইউএন উইমেনের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ এ বিষয় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফোন কলই বলছে মহামারীর এই সময়ে নারী নির্যাতনের হার বেশি। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, মহামারী শুরুর পর ২০২০ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার জন্য মোট ফোন এসেছিল ৯ হাজার ২৪৩টি। আর ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৬৩টি। ২০১৮ সালে এই ফোনকলের সংখ্যা ছিল ৯৩৩টি। ২০১৯ সালে ৬ হাজার ২৯১টি। অর্থাৎ চার বছরে নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ গুণ।

কেস স্টাডি : গত ১৯ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ বন্দরে চলন্ত বাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। বন্দরের মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। পরে কৌশলে নির্যাতিতা বাস থেকে নেমে জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে। জানা যায়, বাসটি মদনপুর এলাকায় পৌঁছানোর পর বাসের সব যাত্রী নেমে গেলে বাসের চালক ও দুই সহকারী চলন্ত বাসে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে সেই গৃহবধূকে ধর্ষণ করে। এর আগে চলতি বছরের মার্চে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় নূর আয়শা (২৫) নামের এক নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শওকত ওসমান নামে এক ব্যক্তি নির্যাতন করে। উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের মোরাপাড়ার হাঁপানিয়াকাটা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ নির্যাতনের ধারণ করা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, শওকত একটি গাছের সঙ্গে শাড়ির আঁচল দিয়ে নূর আয়শাকে বেঁধে রাখে। এ সময় আয়েশা তার বাঁধন খুলে দিতে বলে। কিন্তু শওকত তা না করে তাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আয়েশাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এবং চুল ধরে টানতে থাকে। গত ১৪ ডিসেম্বর শরীরে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন নিয়ে ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতে মৃত্যু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী মেঘলার। এলমার অভিভাবকদের অভিযোগ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, বিয়ের পর থেকেই এলমাকে তার স্বামী ইফতেখার ও স্বামীর পরিবারের লোকজন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। বিয়ের পর থেকে এলমাকে তার নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেওয়া হতো না।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীরা শুধু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন না, তারা স্ট্রিট ভায়োলেন্সেরও শিকার হচ্ছেন। এমনকি নারী এখন পর্যটন স্পটগুলোতেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতনের জায়গাগুলো এখন ভিন্নতর হচ্ছে। আবার যে নারীরা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন তাদের অনেককেই কোথাও না কোথাও যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সাধারণ নারী থেকে প্রখ্যাত নারী শিল্পীও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নারীর প্রতি নির্যাতনকে সমাজ এখন কোনো বিষয় বলেও গ্রাহ্য করছে না।

Related posts

ঢাকা সফরে আসবেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী

Irani Biswash

দেশের পথে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

razzak

ইইউতে বায়ু দূষণে ৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু

razzak

Leave a Comment

Translate »