তিন দিন পরই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভোটযুদ্ধ। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ৭ মেয়র প্রার্থীসহ ১৮৯ প্রার্থীর প্রচারণায় উৎসবমুখর নগরী। নানা প্রতিশ্রুতি আর আশার বাণী নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। আচরণবিধি লঙ্ঘন ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল তাদের প্রচারণা। তবে হেভিওয়েট দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে বাকযুদ্ধ নির্বাচনী মাঠ গরম করলেও পরিস্থিতি এতোদিন অশান্ত হয়নি। তৈমূর আলমও তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন ছাড়া জোরালো কোনো অভিযোগ তোলেননি। কিন্তু আকস্মিকভাবে তৈমূর আলম খন্দকারের সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক ও জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবিসহ বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীকে আটকের মধ্য দিয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ভোটের মাঠে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অশান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে।
গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তৈমূর আলম খন্দকারের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে।
তবে নির্বাচনের ৫ দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী সমন্বয়কারীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি ভালোভাবে নেননি সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগেরও অনেকে এটিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা বলেন, এই ঘটনায় বিরূপ প্রভাব পড়বে নৌকার ভোটে।
এদিকে তৈমূর আলম বলেন, ক্ষমতাসীনরা তার পুরনো চেহারায় ফিরে গেছে। দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মরিয়া হয়ে উঠছে। প্রচারণায় অংশ নেয়া নেতাকর্মীদের আটক ও বাড়ি-ঘরে তল্লাশি চালিয়ে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়া নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আমি এসপি অফিসের সামনে বসে পড়বো। এবং সেখানে বসেই নির্বাচন পরিচালনা করবো। যত কিছুই করা হোক নির্বাচন থেকে সরে যাবো না।
অন্যদিকে শামীম ওসমান ও আইভীকে ঘিরে চলমান বিরোধ শেষ হয়েও যেন হচ্ছে না।
দলীয় নেতাকর্মীদের তথ্য মতে, নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যান শামীম ওসমান বলয়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। নির্বাচন নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটেন শামীম ওসমান। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন পাওয়া আইভী ও তার বলয়ের নেতাকর্মীদের বক্তব্য-বিবৃতি উত্তাপ ছড়ায় ভোটের মাঠে। আইভী প্রচারণায় নেমে নানা প্রশ্ন তোলেন শামীম ওসমানের নীরবতা নিয়ে। তার সঙ্গে ইনিয়ে বিনয়ে সুর মেলান নির্বাচনী কাজে নারায়ণগঞ্জে ছুটে আসা আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। এক পর্যায়ে আইভী তারই দলের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানকে গডফাদার এবং তৈমূর আলম গডফাদারের ক্যান্ডিডেট বলে বক্তব্য দিয়ে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেন। শুধু তাই নয়, রীতিমতো আইভীর পক্ষে মাঠে না নামায় মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এখানেই শেষ নয়, রাতের আঁধারে বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতার বাড়ি বাড়ি হানা দেয় পুলিশ ও ডিবি। এই যখন অবস্থা তখন সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমান। যদিও তিনি বলেছেন, তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সংবাদ সম্মেলন ছিল এটি। তারপরও তিনি বলেছেন, আজ থেকে নৌকার পক্ষে নামলাম। হাতি যত বড়ই হোক কাঁধে নিয়ে দৌড় দিবো। তবু নৌকা ডুবতে দিবো না। শামীম ওসমানের সংবাদ সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ শিবিরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে আইভী বলেছেন, কে আসবে আর কে আসবে না তা দেখার বিষয় আমার না। তাছাড়া ‘উনি (শামীম ওসমান) কিসের পক্ষে প্রচারণা করবেন জানি না, আমার জানার প্রয়োজনও নেই’। ফলে নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েই গেল। এতে সাধারণ ভোটারদের মাঝে শঙ্কা দেখা দিয়েছে নির্বাচন নিয়ে।
ওদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে আটক করার পর গত বছরের ২৮শে মার্চের হরতালে হেফাজতের সহিসংতার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা ২টি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই দু’টি মামলায় তার বিরুদ্ধে ওয়ায়েন্ট রয়েছে বলেও পুলিশ জানায়। খবর পেয়ে জেলা পুলিশ সুপারকে ফোন করে ঘটনা জানান তৈমূর আলম। কিন্তু আশানুরূপ বক্তব্য না পেয়ে রাত পৌনে ১০টায় তিনি ছুটে যান পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে পুলিশ সুপারের সাক্ষাৎ না পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের তৈমূর আলম বলেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। আটক মনিরুল ইসলাম পোলিং এজেন্ট নিয়ে আমার জন্য কাজ করছিল, সেই পোলিং এজেন্টদের নামের তালিকাসহ পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। এর আগেও দু’জনকে আটক করা হয়েছে। যেসব চেয়ারম্যান আমার পক্ষে নির্বাচনে নেমেছিল তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ধামগড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামালের বাড়ি থেকে তার কেয়ারটেকারকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার মাইকিং করা অবস্থায় বন্দর থেকে একটি ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। সোমবার রাতে অহিদ ও জোসেফের বাড়িতে পুলিশ গেছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। এভাবে আমার নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। তারপরও আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে এ যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।
তৈমূর আলম খন্দকারের ব্যক্তিগত সচিব আলাল জানান, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ২৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিএনপি নেতা আব্দুর রহিম ও মনিরুল ইসলাম, ৭নং ওয়ার্ড থেকে সাবেক ছাত্রদল নেতা মাসুম ঢালী, ২২নং ওয়ার্ডে আশরাফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে পুলিশ পরিচয়ে গভীর রাতে ছাত্রদল নেতা জোসেফের বাড়িতে যায় পুলিশ। প্রথমেই তারা বাসার দারোয়ানের মোবাইল ফোন জব্দ করে। এরপর গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে জোসেফকে খুঁজতে থাকে। সেই সঙ্গে জোসেফের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্য বলতে থাকে, জোসেফকে বলে দিস নৌকার পক্ষে যেন কাজ করে। অন্যথায় তাকে ছাড় দেয়া হবে না। এ সময় জোসেফ নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে বাসার ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েন। এতে পা ভেঙে যায়।
পুলিশের অভিযান ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. জায়েদুল আলম বলেন, ‘যারা নির্বাচনে সহিংসতা করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধেই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতেই আমাদের অভিযান।’ তিনি জানান, বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম রবির বিরুদ্ধে সহিংসতার দু’টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।