প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামান এবং জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. খায়রুল ইসলাম রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। ৫ বছর নানা পর্যায়ে গবেষণা করে লেখা বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশনী।
বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সিপেরিমেন্টাল হলে এ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচিত হয়।
লেখকদের সঙ্গে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ হাসপাতালের অন্যতম সংগঠক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ হাসপাতালের নার্স পদ্মা রহমান, ডা. কাজী মিসবাহুন নাহার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন সময় নানান আঙ্গিকে আলোচনা, গবেষণা হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় চিকিৎসাক্ষেত্রে যে বিপুল প্রয়াস তা নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তেমন কোনো গবেষণামূলক নিবন্ধ বা তথ্যসমৃদ্ধ বই ছিল না। দীর্ঘদিনের গবেষণায় ইতিহাসের এই দিকটি ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ বইয়ে তুলে এনেছেন বইটির লেখক শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম। বইটি ভবিষ্যতে একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজে দেবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বইটি লেখা হয়েছে ১১টি অধ্যায়ে। এর মধ্যে স্থান পেয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা, শরণার্থীশিবিরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপুষ্টির যুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক মেডিকেলের ইতিহাস এবং চিকিৎসাযুদ্ধের সাংগঠনিক পর্বের মতো ইতিহাসগুলো।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের অন্যতম সংগঠক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রথম কোনো লেখক মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসা ইতিহাসকে বইয়ের পাতায় তুলে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকরাও যে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন তা অনেকেরই অজানা। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা রাখবে।’
লেখক শাহাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে অতীতের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে। গবেষণার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে যেমন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তেমনি এর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে খায়রুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিক পটপরবর্তন ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যত বেশি সময় গেছে, তত বেশি বদলেছে মানুষের বয়ান। অনেকেই ভুলে গেছেন অনেক ঘটনা। আবার কেউ কেউ বদলেছেন নিজেদের মতামত। এসব নিরপেক্ষভাবে তুলে আনতে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনয়শিল্পী চিকিৎসক কাজী তামান্না বলেন, ‘যে আবেগের জন্ম হয়েছিল দেশভাগের পর থেকেই, সেই আবেগই অনেক মানুষকে একত্র করেছিল দেশের জন্য। কিন্তু “আমরা” থেকে “আমি” ব্যাপারটা এখন বড় হয়ে উঠেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত।’
স্মৃতিচারণা করলেন একাত্তরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীন থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া নার্স বীর মুক্তিযোদ্ধা পদ্মা রহমান। তিনি বলেন, ‘মারণাস্ত্র নয়, জীবনদানের অস্ত্র নিয়ে লড়াই করেছিলাম আমরা। আমাদের হাতে রাইফেলের বদলে ছিল অপারেশনের ছুরি, কাঁচি, ব্যান্ডেজ,যা দিয়ে আমরা প্রাণ বাঁচাতাম।’
‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ বইয়ে ইতিহাসের অনেক প্রামাণিক দলিল এবং সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে না জানা ইতিহাসের অনেক তথ্য। বিস্মৃত ঘটনার সংগ্রহে পরিণত হয়েছে এ বই। ৩০০ পৃষ্ঠার বইটিতে স্থান পেয়েছে বেশ কয়েকজন চিকিৎসাসেনার অভিজ্ঞতার কথা। আছে মন্ত্রিসভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্তের নথি।
বই প্রসঙ্গে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশীদ আলম জানান, ২০২১ সালের ২ মে প্রথমবারের মতো পালন করা হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিবসটি, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। খায়রুল ইসলাম তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ উল্লেখ করে খুরশীদ আলম বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের বহু নতুন তথ্য খায়রুল ইসলাম ছাত্রাবস্থাতেই খুঁজে বের করেছিলেন।
অনুষ্ঠানে সবার শেষে বক্তব্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বইটি রচনার সময় ইতিহাস লেখার সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণাকাজটি হয়েছে নিরপেক্ষ। সাহিত্যের মানেও অসাধারণ। ফলে এটি শুধু বই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস একটি প্রামাণিক দলিল।
উল্লেখ্য, বইটির কয়েকটি নিবন্ধ ২০২০ ও ২০২১ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নিবন্ধগুলোর জন্য লেখকদ্বয় বজলুর রহমান স্মৃতিপদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ বইটির লেখক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শাহাদুজ্জামান ও খায়রুল ইসলাম বইয়ের নানা অধ্যায় ও মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তারা জানান, বইটিতে চিকিৎসা যুদ্ধের শুরু, বাংলাদেশ হাসপাতাল, জিঞ্জিরা গণহত্যা ও পল্লি চিকিৎসকদের ভূমিকা, ঢাকার বাইরের চিকিৎসা যুদ্ধ, নারীরা কীভাবে এগিয়ে এসেছেন সেসব তুলে ধরা হয়েছে। ডাক্তার, মেডিকেল ছাত্ররা কীভাবে বিভিন্ন সেক্টরে, যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করেছে, খালেদ মোশাররফের সার্জারি, শরণার্থীশিবিরে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য-পুষ্টির যুদ্ধ, পরিবেশগত বিপর্যয়, শরণার্থী ব্যবস্থাপনা, ওষুধ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বইটিতে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।