কোনো নাটক-সিনেমার দৃশ্য নয়! দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা হলো বাস্তবে। দেখা হতেই চিৎকার করে বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন সন্তান। অথচ দেশে ফেরার পর যে মানুষটি পরিবারই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় তার পরিবারের সন্ধান মিললো।
সৌদি প্রবাসী সেই ব্যাক্তি হলেন আবুল কাশেম, যিনি ২৫ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব গিয়েছিলেন।
তিনি যখন সৌদি আরব যাত্রা করেন তখন তার মেয়ে রুমা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হননি। বাকি আট ছেলেমেয়েও ছিলো শিশু। দীর্ঘ ২৫ বছর পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিনা পাসপোর্টে গত শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) রাতে দেশে ফেরেন আবুল কাশেম। বাড়ির ঠিকানা বলতে পারছিলেন না তিনি। আবুল কাশেম বলতে পেরেছিলেন কেবল চট্টগ্রামের দুটি এলাকার কথা ও তিন ছেলের নাম।
ঠিকানা না পাওয়ায় আবুল কাশেমকে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের কাছে হস্তান্তর করে বিমানবন্দর পুলিশ। তার কোন পাসপোর্ট ছিল না। তিনি ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে আসেন। এরপর ব্র্যাক মাইগ্রেশন টিমের পাঁচদিনের চেষ্টায় তার পরিবারের সন্ধান মেলে। বুধবার (১৮ জানুয়ারি) আবুল কাশেমকে তার সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
দীর্ঘদিন পর সন্তানদের পেয়ে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর বাবাকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হন সন্তানেরা।
আবুল কাশেমকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর উপলক্ষে রাজধানীর উত্তরার ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, আবুল কাশেম সম্ভবত ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত। স্ত্রী ও তিন ছেলের নাম বলতে পারলেও ঠিকানা মনে করতে পারছিলেন না। বলেছিলেন, ঈদগাহ মাঠের বউ বাজার এলাকায় তার ছেলের তরকারির দোকান আছে।
শরিফুল হাসান আরো বলেন, আঞ্চলিক ভাষা শুনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে। পরিবারের খোঁজ পেতে ব্র্যাক বৃদ্ধার ছবিসহ শ’ শ’ পোস্টার চট্টগ্রামে বিলি করে। তা দেখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটন ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার সহযোগিতায় আবুল কাশেমের ছেলে সবজি ব্যবসায়ী নূর হাসানের খোঁজ মেলে। পরে আবুল কাশেমের অন্য সন্তান ও তার স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আবুল কাশেমের বড় ছেলে নূর হাসান। বাবাকে ফিরে পেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ব্র্যাকসহ আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। অনেক দিন ধরে বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমরা জানতাম না, তিনি সৌদি আরবের কোথায় আছেন। তিনি যে দেশে এসেছেন, সেটাও আমরা জানতাম না। পোস্টার দেখে ও স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে ব্র্যাকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সঙ্গে কাজ করছি। এই প্রবাসীকেও আমরা ব্র্যাকের কাছে দিয়েছিলাম।’
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার মো. রাসেল তালুকদার বলেন, ‘এমন ঘটনা আমরা সব সময় সিনেমাতেই দেখি। বাস্তবে এই প্রথম আমি ঘটনার সাক্ষী হলাম।’
এ সময় শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল আলম, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল হান্নান ও আবুল কাশেমের মেয়ে পারভীন আক্তার উপস্থিত ছিলেন।
হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বুধবার বিকেলে আবুল কাশেমকে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তার সন্তানরা। আর এর মাধ্যমে অবসান হলো ২৫ বছর পর দেশে ফিরে পরিবার খুঁজতে থাকা এক অসহায় প্রবাসীর দুর্দশা।